জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টিকর্ম, বিশেষত, কবিতা নিয়ে অজস্র আলোচনা হামেশাই হচ্ছে। তার উপর, দেবীপ্রসাদ, ভূমেন গুহ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, গৌতম মিত্রসহ আর আর মহারথীরা যেসব অতুল কর্ম সাধন করে গেছেন, তার পরে আমার মত নাদানের পক্ষে আলোচনা করতে যাওয়া নেহায়েতই ধৃষ্টতা। তাই পণ্ডিতির পাশ কাটিয়ে একটি পক্ষপাতদুষ্ট অন্তরঙ্গ আলোচনাই আমার মূল উদ্দেশ্য।
আমি আজকে দুএকটি কথা, একান্তই নিজের স্বল্পবুদ্ধিজাত অনুভূতির সারবত্তা পেশ করতে চাই জীবনানন্দের কবিতাভাবনা বিষয়ে। গোড়াতে যে বলেছি, আলোচনাটা পক্ষপাতদুষ্ট, তা এমনি এমনি বলিনি। কারণ, জীবনানন্দে কবিতার কথা পড়ার আগে, ওয়ার্ডসওয়ার্থের থিয়োরি অব পোয়েটিক ডিকশন পড়ার বহু বহু আগে, কবিতার পাঠক হয়ে ওঠার শিশুকালেই কবিতা বিষয়ক একধরণের প্রতীতি আমার জন্মেছিল। পরে জীবনানন্দের ভাবনা পড়ার সময় আমার ভাবনার সাথে তার আশ্চর্য মিল পেলাম। মিল পেলামই শুধু না, আমার ভাবনার অসম্পূর্ণতাগুলো পুরন করে দিলেন জীবনানন্দ। কবিতার কথার পয়লা অনুচ্ছেদ যখন পড়লাম (পাঠক ক্ষমা করবেন দীর্ঘ উদ্ধৃতির জন্য),
“সকলেই কবি নয়। কেউ-কেউ কবি; কবি—কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে-সঙ্গে আধুনিক জগতের নবনব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে, তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।”
প্রথম প্যারাতেই আমি কাত। এ যে আমারই কথা। এবং এর ঠিক পরেই তিনি একটি মোক্ষম কথা বলে দিলেন। যে কথাটি বলে তিনি কবিদের নবুয়তি খারিজ করে দিলেন। বললেন যে কবির যে কল্পনা, সে কি ঈশ্বরদত্ত? যদি ঈশ্বরদত্তই হয়, তাহলে তো কোনো আলোচনা চলে না আর। তাঁর ভাষায়, “একটি সুন্দর জটিল পাককে যেন হিরে’র ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম।” বরং, তিনি সেটাকে বুদ্ধি দিয়ে অনুসন্ধানের পক্ষে তিনি। এই “সুন্দর জটিল পাককে” তিনি “মাথার ঘাম পায়ে ফেলে” সমাধান করার পক্ষে। কবিতাকে যারা একটি দুর্জ্ঞেয় ও অতিলৌকিক বিষয় হিসেবে দেখতে ভালবাসেন, আমার কাছে তাদেরকে বরাবরই অলসবুদ্ধির বুজুর্গ বলে মনে হয়েছে। আমিও জীবননান্দের মতই কবিতার এই রহস্য “মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই” বোঝার চেষ্টা করেছি।
জীবনানন্দের কাছে যেখানটায় বিশেষভাবে আমি ঋণী, তা হ’ল, কী হলে কবিতা কবিতা হয়, তা পষ্ট করে আমাকে বুঝিয়ে দেবার জন্য। যে উদ্ধৃতিটা দিয়ে শুরু করেছি, সেখানে তিনি বলছেন যে কবির হৃদয়ে যে “কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা” থাকে, তা নানারকম “চরাচরের সম্পর্কের” ছোঁয়াচে এসে কবিতা সৃষ্টি হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, “আট বছর আগের একদিন” কবিতায় কবি এক জায়গায় বলছেন,
“দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ মরণের সাথে লড়িয়াছে”।
এ হলো চরাচরের কথা, কবির অভিজ্ঞতাজাত। আমার শৈশব মনে পড়ে। ফড়িং ধরে মাথাটা কয়েক পাক ঘুরিয়ে দিতাম। ফড়িংটা খনিকক্ষণ হতভম্ভ হয়ে থাকতো। তার পাগুলো দিয়ে যা সামনে পেতো, আঁকড়ে ধরতো। তখন জামার উপরে বসিয়ে দিলে জামা আঁকড়ে পড়ে থাকতো। ধাতস্থ হবার চেষ্টা করতো। খানিক্ষণ পরে সে আবার উড়ে যেত। আবার, এই খেলায় ফড়িঙটা মারা যেত মাঝে মাঝেই তার স্নায়ুরজ্জু ছিঁড়ে। এই যে অভিজ্ঞতা, কবি কিন্তু সেটিই বর্ণনা করে কেবল ক্ষান্ত হননি। এর পরেই তিনি বলছেন,
“যে জীবন ফড়িঙের-দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা”।
এই হলো, তাঁর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা।
এইভাবেই জীবনানন্দ আমাকে কবিতা চিনিয়েছেন। তাঁকে পড়তে পড়তে জেনেছি, যা আমরা দেখি, তা-ই কেবল কবিতায় দৃশ্য নয়, যা আমরা শুনি তাই কেবল কবিতায় শ্রাব্য নয়। আমাদের দেখার অতীত আরো কোনো দৃশ্য আমরা কবিতায় দেখতে পাই, আরো কোনো অনাহত ধ্বনি আমাদের মগজের কোষে রণিত হয়। সেই দৃশ্যকল্প ও কল্পরণন আমাদের এই চরাচরের বাস্তবতা ছাড়িয়ে আরেক বাস্তবতায় নিয়ে যায়। যেখানে,
“…পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;
চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;”
কবিতার বাস্তবতা নিয়ে জীবনানন্দের পষ্টাপষ্টি কথা। জীবনের বাস্তবতা আর কবিতার বাস্তবতা এক না। তাদের দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে, তবে তা সরাসরি প্রকাশ্য সম্পর্ক না, সুড়ঙ্গপথে গোপন সম্পর্ক। ফলে কবিতা আসলে জীবনের দর্পন না। তাঁর মতে, কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুইরকম উৎসারণ। মানুষের কাছে কবিতার দরকারটা কী, তাও তিনি খুবই অদ্ভুতভাবে বলেছেন। বলেছেন, কবিতা হাজার হাজার বর্গমাইল জনতার উদ্দেশ্যে পাদরির বাইবেল বিতরণের মত না। কবিতার উপযোগটা অন্যরকম। তাঁর ভাষায়,
“প্রথমত শ্রেষ্ঠ কবিতার ভিতর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই যে, মানুষের তথাকথিত সমাজকে বা সভ্যতাকেই শুধু নয়, এমন-কি সমস্ত অমানবীয় সৃষ্টিকেও যেন তা ভাঙছে—এবং নতুন করে গড়তে চাচ্ছে; এবং এই সৃজন যেন সমস্ত অসঙ্গতির জট খসিয়ে কোনও একটা সুসীম আনন্দের দিকে। এই ইঙ্গিত এত মেঘধবলিমা গভীর ও বিরাট, অথচ এত সূক্ষ্ম যে, ব্যক্তি সমাজ ও সভ্যতা তাকে উপেক্ষা করলেও (সব সময় উপেক্ষা করে না যদিও) এই ইঙ্গিতের প্রভাবে তারা অতীতে উপকৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক ভাবে উদ্ধার লাভ করতে পারে।”
জীবনানন্দ আশা করেননি কখনো, সমাজের বিপুল অধিকাংশ পাঠক কখনো কবিতার নিবিষ্ট পাঠক হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রথম শ্রেণির কবিদের প্রতি সভ্যতার নিগ্রহে কবি কষ্ট পেয়েছেন, খেদোক্তি করেছেন। বলেছেন, সভ্যতা যেন “হস্তীজননীর” মত “দাঁতাল বুদ্ধিস্খলিত” সন্তানের জন্ম দিয়ে পৃথিবী ভরিয়ে ফেলেছে। কথাটি তিনি মিথ্যে বলেননি একদমই। আজ তাঁর মৃত্যুর ৬৬ বছর পরে এসে কথাটি যেন আমাদের সভ্যতার শরীরে এক অগ্নিময় ক্ষতর মত জ্বলজ্বল করছে। তবু তিনি শেষতক আশা নিয়ে বলেছেন,
“তার প্রতিভার কাছে কবিকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তাে কোনও এক দিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্ত প্রয়ােজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্যে।”