মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর উপলক্ষে বই প্রকাশের ঢল নেমেছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষেও বলতে দ্বিধা নেই, অধিকাংশ চর্বিতচর্বন। হয়তো অজস্র গ্রন্থের ফাঁকে দুটো চারটা টিকে যাবে।
কিন্তু আশঙ্কা হলো বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে এটা একটা বিপর্যয় ডেকে আনবে। এই বিপুল মোসাহেবি-গ্রন্থমালা কোথায় যেয়ে জমা হবে? এই শত শত বইয়ের মাঝে কোন কোনটা আপনি কিনবেন? তাহলে শেষ পর্যন্ত কারা সেগুলো কিনবে?
বুঝতেই পারছেন, যারা এগুলো লিখছেন এবং যারা ছাপছেন, তাদের বড় অংশই অতি ধুরন্ধর ও ঘাঘু আদমী। আপনার আমার বইকেনার ওপর তাদের ভরসা নাই। কিন্তু কী করিলে কী হয় সেটা তারা ভালোই জানে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যন্ত হুকুমদারি করে ভাই-বেরাদর-ভাগ্নে-শ্যালিকাদের বই কিনতে বাধ্য করাটা এখানে আমলাতন্ত্র এবং গুণ্ডাতন্ত্র উভয়টির ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ঠিকঠাকমত একটা দাঁও মারার এই অনবদ্য সুযোগটিকে তারা ছাড়বেন কেন?
এগুলোর পেছনে বাধ্যতামূলক ব্যয়ের পর শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন-রাজনীতির বই প্রতিষ্ঠানগুলো কিনতে পারবে তো? এমনিতেই তো এদেশে প্রতিষ্ঠানগত ক্রয়ের অভাবে প্রকাশনা শিল্প বিপন্ন! তাই ভয় হয়, ওই ছিটেফোঁটা বরাদ্দটুকুও যদি মোসাহেবিতে ব্যয় হয়ে যায়, প্রকাশনা শিল্পের হয়তো আরও একটু সর্বনাশ হবে।
আজ না হোক, ভবিষ্যতের মানুষ নিশ্চয়ই এগুলোর সারবত্তা নিয়ে বিচারবিবেচনা করবেন। ইতিহাসের বিচার বলে যে কথাটা আছে, সেটা একদম মিছা নয়। তবে খুব ভালো হতো, এবছরই একটা সত্যিকারের গবেষণা হতে পারে, এই গ্রন্থগুলো কারা কারা প্রকাশ করলো, কে কার গ্রন্থ প্রকাশ করলো, কারা কারা সেগুলো কিনলো, কোন কোন সংস্থার টাকা খরচা হলো সেগুলো কিনতে।
এমনকি এটাও বিবেচনা করা যেতে পারে, এই গ্রন্থগুলোর কোন কোনটিতে পর্যালোচনামূলক কিছু আদৌ আছে কি না, নাকি পুরোটাই স্তুতি-সাহিত্য। মোসাহেবদের জন্য পঞ্চধাপের একটা পদকও চালু করা যেতে পারে: শতস্তুতি, সহস্রস্তুতি, অযুতস্তুতি, নিযুতস্তুতি, লক্ষস্তুতি… লক্ষ্য যেহেতু স্তুতিই।
বরং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, উনসত্তুর নিয়ে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে এবং শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ নিয়ে যদি সত্যিকারের কোন ভালো নতুন বই প্রকাশিত হয়, কিংবা যেগুলো অতীতে রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলাপটাও আমাদের সামনে আনা দরকার। মোসাহেবদের আছে খুঁটির জোর, ফলে সচেতন পাঠকদের দিক থেকেও এইটুকু সংঘশক্তির নিদর্শন খুব জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর কিভাবে সবচেয়ে ভালো ভাবে পালন করা যেতে পারতো? হয়তো একটা উপায় হতে পারতো, বিজ্ঞান-ইতিহাস-দর্শন-প্রতিবেশ-অর্থনীতি-রাজনীতির মত আরও পঞ্চাশটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বাংলা ভাষায় পঞ্চাশ খণ্ডে একটা জাতীয় জ্ঞানভাণ্ডার প্রকাশ করে। একইভাবে হয়তো মুজিববর্ষও সবচেয়ে ভালোভাবে পালিত হতে পারতো শতগ্রন্থের উদ্যোগ নিয়ে।
কিন্তু সে হবার নয়। আপাতত স্তুতি পর্বে আছি আমরা।