জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় দাবি করেন ‘জিম্মা’ শব্দটা বাংলাভাষায় নেই, পশ্চিমবঙ্গে কেউ এটি ব্যবহার করেন না। ভদ্রলোককে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক: “…আমরা ভাষা নিয়ে ভাবছি না। এই ভাবছি না বলে আমাদের এই বাংলাভাষায় অদ্ভুত অরাজকতা; অর্থাৎ আগাছা ঢুকে গেছে। এখন আপনি দেখুন, আপনি যখন কবিতা লেখেন যে ভাষায় লেখেন, আপনি যখন গদ্য বা গল্প লেখেন সে ভাষায় লেখেন না। কেন এই পার্থক্য?
কেন এই ভাষায় এতো উর্দু-আরবি-ফারসি ঢুকল? যে উর্দুর জন্য ৫২ সালে মানুষ আত্মত্যাগ করলেন, সেই উর্দু শব্দ কেন বাংলাদেশের ভাষায় ঢুকলো, এটা নিয়ে কেউ ভাবেন নি, কোনো কথা বলেন নি। আমার একটা প্রস্তাব ছিল, একটা কমিটি তৈরি করে বাংলাভাষার একটা স্ট্যান্ডার্ড চেহারা দেওয়া হোক। এটা আগের চেয়ে ডেভেলপড এবং আগাছাগুলোকে ঝেড়ে ফেলা হোক… যেমন ধরুন, আজকের কাগজে আছে, কতজন বাঙালি বা বাংলাদেশিকে লিবিয়া জিম্মা নিয়েছে, ৪০০ বাঙালি। ‘জিম্মা’ শব্দটা কেন লিখবে?’ ‘জিম্মা’ তো বাংলা শব্দের ধারে কাছে নেই।… আত্মীকরণ দিয়ে বুঝতে চান, যেকোনো ভাষার উপর শব্দ আসবে। যেমন, ইংরেজিতে টেবিল, চেয়ার, শার্ট, প্যান্ট হিসেবে এসেছে। সেটা অভ্যেস হিসেবে এসেছে। পশ্চিমবাংলায় কোনো মানুষের ভাষায় জিম্মা শব্দ শুনবেন না। কবিতা পড়েন, গদ্যে পড়েন, গল্প পড়েন।কোথাও জিম্মা শব্দটা ছিল না। এগুলো কেন জানি মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পর থেকে এইসব শব্দ টুকটুক করে ঢোকাচ্ছে। আমার চেয়ে আপনারা ভালো বুঝবেন!”
(যেগুলো আকাশে ভাসে সেগুলো তাৎক্ষণিক সাহিত্যঃ সাখাওয়াত টিপু ও ফরিদ কবির এর সাথেকথোপকথন)
তথ্যগত দিক দিয়ে সমরেশের দাবি যে অত্যন্ত, অত্যন্ত ভুল তাতে সন্দেহ নেই। ভুলটা শুধু এদিক দিয়ে নয় যে ‘জিম্মা’ শব্দটিকে সমরেশ এখনও অনাত্মীয়জ্ঞানে বর্জন করে চলেছেন, বরং এদিক দিয়েও যে ভাষার গতিশীলতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে ভাবনাটির প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন, তা নিতান্তই কিশোরসুলভ সরল, এবং বিপদজনক রকম রক্ষণশীল। ‘জিম্মা’ শব্দটির পক্ষে সমরেশ মজুমদারের তুলনায় বাংলা ভাষার অনেক বড় ওজনদার, অনেক বেশি মহত্তর সাক্ষীর দোহাই দিতে পারি, তিনি রবীন্দ্রনাথ। ‘কাব্যঃ স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট’ নামের একটা রচনায় খোলাসা করে সব কিছু লেখার দাবি করা পাঠককে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন সেকালের এক বাজারচলতি ঔপন্যাসিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের জিম্মায়ঃ “কপালকুণ্ডলার শেষ পর্যন্ত শুনিয়া তবু যদি ছেলেমানুষের মতোজিজ্ঞাসা কর ‘তার পরে?’ তবে দামোদর বাবুর নিকটে তোমাকে জিম্মা করিয়া দিয়া হাল ছাড়িয়া দিতে হয়।”
বাঙাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, ভাগ্যিস রবি ঠাকুরের বরাত দেয়া গেলো, নাহলে জিম্মা-জিম্মি-জিম্মাদার এর মত কতগুলো অতি জরুরি শব্দও ‘অনাত্মীয়’ তকমায় ভেতর বাড়িতেআর ঢুকতে পেতো না, সমরেশীয় শুদ্ধি অভিযানে হয়তো বিদায় দিতে হত। পশ্চিমবঙ্গে আদৌ ব্যবহৃত না হয়ে যদি থাকেও, পূববাংলায় তো কিছু পরিস্থিতির প্রকাশে জিম্মা ব্যবহার অনিবার্য। কিন্তু প্রশ্নটা তো এখানে না যে জিম্মাদার রবিঠাকুর ব্যবহার করে সেটাকে আত্মীয়ের স্তরে শোধন করেছেন, তার গদ্যে সম্ভবত শব্দটা একবারই ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েছিল। সঙ্কটটা আসলে খবরদারির, একটা নির্ধারক মানসিকতার। যে কোন কারণেই হোক, পূববাংলার দিক থেকে এই খবরদারির কিংবা শুদ্ধাশুদ্ধি বিচারের চেষ্টার কোন খবর পাওয়া যাবে না। খবরদারি না করতে যাবার পেছনে কিন্তু ঔদার্য বা স্বভাবসিদ্ধ মহত্ত্ব নেই, বরং পূর্বাঞ্চলের যে সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা আর পরমুখাপেক্ষিতা পশ্চিমাংশের প্রতি, তারই একটা স্বাভাবিক স্বীকৃতি আছে এই মুরুব্বিগিরি না করার চেষ্টায়। কিন্তু এটাও আশ্চর্য কম নয় যে পশ্চিমের ঐতিহ্যগত আভিজাত্য আর প্রাধান্যের পরও, এমনকি পূর্বের মননকে চুম্বকের মত শক্তিতে বালু থেকে লৌহকণাকে আলাদা করে নিজের বলয়ে নিয়ে যাবার সক্ষমতার পরও, পূববাংলার জল-কাদামাখা বুনো প্রাণশক্তিও কখনো অলক্ষ্যে এবং কখনো প্রকাশ্যে ঠিকই আপন সাম্রাজ্য বিস্তার করে গেছে।
পূব আর পশ্চিমে বাংলার শব্দরীতি-পরিভাষা ব্যবহারের ঐতিহাসিক কিছু পার্থক্য নিয়ে, আঞ্চলিকতার বিষয়টি সেখানে কত গভীর ছিল, কিভাবে তা আঞ্চলিকতার ব্যপ্তি ছাড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার রঙেও সিক্ত হল, কিংবা এর মাঝে ‘সভ্য বাঙালি’ বনাম ‘অমার্জিত বাঙাল’ এই দুইয়ের রেষারেষির ইঙ্গিত এখনও কিভাবে বর্তমান, সেটাই আরও একবার বিবেচনা করতে বসা যেতে পারে। ‘জিম্মা’ শব্দটা ঠাকুর যদি ব্যবহার না করতেন, সমরেশ মজুমদারের দাবি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে অদ্যাবধি তার আত্মীয়করণ না ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে বাঙালের কর্তব্য কি সেই মানদণ্ডে বিচার করে নিজ ভাষাকে শুদ্ধ করার যজ্ঞে নেমে পড়া — এই সব বিটকেলে ভাবনা শুধু নয়, পুরো বিষয়টার একটা সামান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতও হাজির করা যেতে পারে।