সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, যাকে বাঙলায় বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে একরকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। শব্দটা সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই, শিক্ষিত মহলেও খানিকটা নতুন। মানুষ মনে করছে, আমাদের যে সামাজিক সংহতি বা সহমর্মিতা তার উল্টোটা ঘটবে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংএ। এইখানটাতেই একটু বিশেষভাবে পরিস্কার হওয়া দরকার। মনে রাখা দরকার, এই শব্দটা আমাদের নিত্যব্যবহার্য শব্দ না। এটা একটা টার্ম বা পদ। বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থে এটা ব্যবহার করা হয়। এখন, সেই বিশেষ ক্ষেত্রটাই বা কী আর বিশেষ অর্থটাই বা কী?
বিশেষ ক্ষেত্র হলো, যখন কোনো রোগের মহামারী শুরু হয় তখন। মহামারী একটা দেশের মধ্যে হতে পারে, তখন তার নাম হয় এপিডেমিক। নানান দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন তার নাম হয় প্যানডেমিক। এইরকম সময়ে এই শব্দটা ব্যবহার করা হয় সারা বিশ্বে। সারা পৃথিবীর ডাক্তার, সেবাকর্মী, স্বাস্থ্যপ্রকৌশলী, রোগতত্ত্ববিদ সবাই এটা ব্যবহার করেন।
এখন দেখা যাক এই বিশেষ ক্ষেত্রে এই শব্দবন্ধের বিশেষ অর্থটা কী? সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বা বাঙলায় যাকে আমরা বলছি সামাজিক দূরত্ব, তার দ্বারা আসলে কতকগুলো নির্দেশনা বোঝায়, রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে যেগুলো মানা আবশ্যক। এখন প্রশ্ন হলো, কেন সেটাকে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নাম দেওয়া হলো?
চলতি ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘সোশালাইজিং’। চলতি ইংরেজিতে এটার মানে হলো, মানুষের সাথে সামাজিকতার চর্চা করা। অর্থাৎ, কারো বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, দেখা হলে হাত মেলানো, কোলাকুলি করা, চুমু দেওয়া ইত্যাদি। এই সোশ্যালাইজিং করতে গিয়ে মনের অজান্তেই মানুষ অসংখ্যবার মানুষকে স্পর্শ করে নানাভাবে। ফলে, মহামারির সময় যদি সোশ্যালাইজিং বন্ধ রাখা যায়, তাহলে স্পর্শ করার প্রবণতা অনেকাংশেই কমে যায়। সেই কারণেই বলা হয় সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, অর্থাৎ সোশ্যালাইজিং থেকে বিরত থাকা।
কিন্তু, এই বিশেষ ক্ষেত্রে কিন্তু কেবল সামাজিকতা বন্ধ রাখাই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং না। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এক্ষেত্রে আরেকটু বিশদ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর কতকগুলো মেজার বা পরিমাপ রয়েছে। যেমন
১। সোশ্যাল ক্লোজার বন্ধ করা: যেটা একটু আগে বললাম। সামাজিকতা করতে গিয়ে কাছাকাছি আসা। সেটা প্রোঅ্যাকটিভ হতে পারে, অর্থাৎ নিজের উদ্যোগে হতে পারে। যেমন, দেখা হলে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরা। আবার রিঅ্যাকটিভ হতে পারে, অর্থাৎ হাতটা ধরতে দেয়া।
২। ওয়ার্কস্পেস ক্লোজার বন্ধ করা: কর্মক্ষেত্রে বা বৈবসায়িক কারণে যে ছোঁয়াছুঁয়ি হয় সেটা বন্ধ করা।
৩। আইসোলেশন: এটাও আবার আরেকটা টার্ম। মোটা দাগে, বিচ্ছিন্ন করে রাখা বোঝায়।
৪। কোয়ারেন্টিন: মানুষ ও জিনিসপত্র স্থানান্তরে বিধিনিষেধ আরোপ করা যাতে রোগ কম ছড়ায়।
৫। কর্ডন স্যানিটায়ার: একটা এলাকার মধ্যে মধ্যে লোক প্রবেশ করা বা বের হওয়ায় বিধিনিষেধ আরোপ করা।
৬। গনজমায়েত বন্ধ করা: অর্থাৎ, মিটিং, সমাবেশ, সিনেমা, খেলাধুলা, উৎসব ইত্যাদি বন্ধ করা।
৭। গনপরিবহণ সীমাবদ্ধ করা: গণপরিবহনের চলাচলে কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় বা প্রয়োজনবোধে বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে রোগ সংক্রমণ কম হয়।
৮। সেল্ফ শিল্ডিং বা আত্মসুরক্ষা: যেটাকে আমরা সেল্ফ কোয়ারেন্টিন বলছি আর কী।
এই সবকিছু মিলিয়েই একসাথে বলা হয় সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং। ফলে, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং শুনে মনে করার দরকার নেই যে এটা মানুষের সামাজিক সংহতিবিরোধী কোনো ব্যাপার। বরং, এই বিপদের সময়ে এর অর্থটা সকলের কাছে পরিস্কার হওয়া দরকার। কেননা, এটা এখন একটা বৈশ্বিক লড়াই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী বলতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে পারা আমাদের সুরক্ষার জন্যেই দরকারী। ভুল বুঝলে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।